অপার সৌন্দর্যের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ, একদিকে পাহার আর অপর দিকে সমুদ্র, হরেক রকমের মানুষের বসবাস এই দেশে । বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষের বৈচিত্রময় জীবন দেশটিকে গড়ে তুলেছে আরো বৈচিত্রমন্ডিত । পৃথিবীতে এখনও বহু উপজাতি এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । উপজাতীয়রা প্রধানত এখনও আদিম আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । এরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখনও তাদের আদিপ্রথা বিসর্জন দিতে পারেনি । সম্ভবত এজন্যই তাদেরকে ‘আদিবাসী’ও বলা হয়ে থাকে । এসব উপজাতীয়রা তাদের নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে যা লিখিত নয় । নিজস্ব সংস্কৃতি এবং আইন দ্বারা জীবন অতিবাহিত করে । বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন জাতি উপজাতি । বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসি কিংবা উপজাতির বসবাস । বছরের পর বছর তারা এ্ইসব এলাকায় বসবাস করে আসছে । আর এসব বহু উপজাতীয়দেরই একটি গোত্র হচ্ছে গারো উপজাতি ।
গারো উপজাতি (Garo Tribe) বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে গারোদের আবির্ভাব আনুমানিক চার হাজার বছর আগে । কিন্তু এরা কোথা থেকে এসে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করেছে তা নানা বিতর্কে আবদ্ধ । তবে গারোদের উৎপত্তিস্থল হিসাবে গবেষকগণ হিমালেয়ের চীন-তিব্বত এলাকা বলে ধরে নিয়েছেন । তারা প্রধানত বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর এবং টাঙ্গাইল জেলার কিছু অংশে এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় অঞ্চলে বসবাস করে। গারোরা নিজেদেরকে “আচিক” বলে, যার অর্থ পাহাড়ের মানুষ। তাদের ভাষা গারো, যা তিব্বতী-বর্মী ভাষা পরিবারভুক্ত।
দৈহিক বৈশিষ্ট্যঃ গারোদের দৈহিক আকৃতি মাঝারি ধরনের, চ্যাপ্টা নাক, চোখ ছোট, ফর্সা থেকে শ্যামলা রং। দৈহিক গঠনে বেশ শক্তিশালী। তাদের চুল সাধারণত কালো, সোজা এবং বেশ ঘন হয়ে থাকে । আবার অনেক কোকড়া চুলের অধিকারীও লক্ষ্য করা যায় ।
জীবিকা : গারো উপজাতির প্রধান জীবিকা কৃষি, বিশেষ করে জুম চাষ। তারা ধান, গম, এবং বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করে। এছাড়াও তাঁরা পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং বনজ সম্পদ সংগ্রহের সাথে যুক্ত।
গারো উপজাতির জীবনধারা প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কালের সাথে মানিয়ে চলার জন্য অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, তবে তারা এখনও তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
- বাংলাদেশি গারো উপজাতিদের জীবন – bangladesh tribal life
- বাংলাদেশ ২৩৩ রানে অলআউট – মুমিনুলের সেঞ্চুরিতে লড়াই
- চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্নিকাণ্ড – নিয়ন্ত্রণে বন্দর ও কোস্টগার্ড
- যেসব ব্যাংকে টাকা রাখলে আপনার টাকা গায়েব হয়ে যেতে পারে
- বাংলাদেশ গরীব রাষ্ট্র নয় বিভিন্ন দেশে মিলছে সম্পদের খোঁজ
সামাজিক গঠন ও পরিবার : গারো উপজাতির সমাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা । এই ব্যবস্থায় উত্তরাধিকার এবং সম্পত্তি হস্তান্তর নারীর মাধ্যমে হয়, যা আদিবাসী সমাজে বিরল। কন্যা সন্তান, বিশেষত ছোট কন্যা সন্তান, পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। পরিবারের বড়রা এবং মায়েরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ব্যবস্থা নারীদের জন্য বেশ সম্মানের এবং ক্ষমতার অবস্থান নিশ্চিত করে।
বিয়ে ও সম্পর্ক : গারো সমাজে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী’র পরিবারের সাথে বসবাস করে। এই প্রথাকে ম্যাট্রিলোকাল বলা হয়। গারোদের মধ্যে বিবাহ প্রথায়, একটি বিশেষ দিক হল “চাদোং” নামে পরিচিত। চাদোং একটি সামাজিক বা পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমে মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র নির্বাচন করা হয়। বিয়ের আগে বর ও কনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা এবং দুই পরিবার একত্রিত হওয়ার গুরুত্ব রয়েছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার : প্রাচীনকাল থেকে গারো উপজাতির ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকৃতিপূজার উপর ভিত্তি করে ছিল। তারা প্রকৃতি, দেবতা এবং পূর্বপুরুষদের পূজা করত। মূলত গারোদের ধর্মীয় জীবন ছিল আনিমিজম (Animism) বা প্রাণবাদ ধর্মের অনুসারী, যেখানে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির পূজা করা হয়। তারা বিশ্বাস করত যে পৃথিবী এবং এর প্রকৃতি দেবতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
বর্তমানে, গারোদের মধ্যে ব্যাপক খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা দেখা গেছে, বিশেষত প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্ম। তবে, অনেক গারো তাদের পূর্বপুরুষদের আচার ও বিশ্বাসের কিছু অংশ এখনও মেনে চলে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে নাচ, গান এবং ধর্মীয় প্রার্থনা উল্লেখযোগ্য।
উৎসব ও সংস্কৃতি : গারোদের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল ওয়ানগালা (Wangala)। এটি ধান কাটার পর উদযাপিত হয় এবং “১০০ ড্রামের উৎসব” নামেও পরিচিত। এই উৎসবে পূর্বপুরুষ ও দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়, এবং ধানের ভালো ফসলের জন্য প্রার্থনা করা হয়। উৎসবের সময় পুরুষরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ঢোল বাজায় এবং নাচে অংশ নেয়। নারীরাও ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে নৃত্যে অংশ নেয়।
ভাষা ও সাহিত্য : গারো উপজাতির ভাষা হল গারো ভাষা, যা তিব্বতী-বর্মী ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। গারো ভাষার একটি নিজস্ব লিপি নেই, তবে বর্তমানে রোমান বর্ণমালা ব্যবহৃত হচ্ছে। গারো ভাষার কিছু সাহিত্যকর্ম রয়েছে, তবে সেগুলি খুব বেশি প্রচলিত নয়। ভাষার শিক্ষাদান ও সংরক্ষণে এখন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক জীবন : গারোদের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর। তারা জুম চাষ (Slash-and-burn agriculture) করে, যেখানে পাহাড়ি জমিতে ফসল ফলানোর জন্য গাছপালা কেটে জমি প্রস্তুত করা হয়। ধান, ভুট্টা, আলু, এবং অন্যান্য শস্য চাষ তাদের জীবিকার প্রধান উপায়। তারা পশুপালন এবং বনজ সম্পদ সংগ্রহের কাজও করে। গারোদের মধ্যে মৎস্য চাষ এবং ছোটখাটো ব্যবসা করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
আধুনিক সময়ে পরিবর্তন : আধুনিককালে গারো উপজাতির জীবনধারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রসার তাদের জীবনমান উন্নত করেছে। যদিও অনেক গারো তাদের প্রথাগত জীবনধারা ও সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত রয়েছে, তবে নতুন প্রজন্ম আধুনিক শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে। অনেক গারো তরুণ-তরুণী শহরে কর্মসংস্থানের খোঁজে যাচ্ছে এবং তাদের মধ্যে আধুনিক জীবনের বিভিন্ন প্রভাব পড়ছে।
সংরক্ষণ ও উন্নয়ন : গারোদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবিকার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে তাদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা চলছে, তবে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
গারো উপজাতি বাংলাদেশের এক উল্লেখযোগ্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী যারা তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত। তাদের সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় আচার, এবং জীবনের প্রতিটি দিকের মধ্যে রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক এবং সামাজিক তাৎপর্য।